প্রেম রোগে ভুগছেন না তো??
প্রশ্ন: “প্রেম” এই শব্দটির সুধাতেই আমরা পাগল হয়ে উঠি। এটাকে আপনি বলছেন রোগ। প্রেম কি সত্যি একটা রোগ? বিষয়টা সবিস্তারে বুঝতে চাই।
শেখ শাহ: না, প্রেম কোনো রোগ নয়। তবে Love বা প্রেম বলতে আজকের পৃথিবীতে যা বোঝানো হয় তা পুরোটাই একটা রোগ। আমরা তাকে বলছি LD (Love Disease) বা প্রেমরোগ। খুব অল্প বয়সেই তুমি এটা বাঁধিয়ে বসো এবং নিজের উপরে এটাকে এত তীব্র হতে দাও যে সেটা একেবারে মহামারির মত তোমার উপরে জেঁকে বসে। ফলস্বরূপ হয় তুমি প্রাণে মরো আর না হয় তুমি মরার মত বাঁচো। এ রকম বাঁচতে খুবই উচ্চমূল্য চোকাতে হয়। অনেকটা ICU তে বাঁচার মত। কিন্তু এত উচ্চমূল্য দেওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব হয় না। ফলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে।

বিষয়টা না বুঝলে চলো একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। ধরো, কোনো একটা মেয়েকে তোমার ভালো লাগল অর্থাৎ তোমার চোখটা কোনো একটা মেয়ের প্রতি আটকে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে তোমার ভিতরের রসায়নটা কী? ঠিক কী ঘটল তোমার ভিতরে? আসলে তোমার আবেগ মধুর হয়ে উঠেছিল। কিছুটা সময় তুমি এক অনির্বচনীয় শান্তি অনুভব করেছিলে। এটা কোথায় ঘটল? ওই মেয়েটার মুখে নাকি তোমার ভিতরে? তোমার ভিতরে। ওই মেয়েটা হয়ত অনুঘটকের কাজ করেছে কিন্তু রসায়নটা তোমার আর ঘটার স্থানটা তোমার ভিতরে। তুমি যদি ইচ্ছুক হও সামান্য কিছু সাধনার দ্বারা ওই অনাস্বাদিত অনির্বচনীয় পুলকানন্দ সর্বক্ষণ তোমার ভিতরে জারি রাখতে পারো কোনো অনুঘটক ছাড়াই। সেটা কীভাবে সম্ভব তা এক ভিন্ন আলোচনা। কিন্তু এই মুহূর্তে তোমার মুশকিল হল ওই আনন্দ তুমি ধরে রাখতে পারলে না। ওই আনন্দের অভিজ্ঞতা বেশিরভাগ মানুষেরই রয়েছে কিন্তু তারা সেটাকে ধরে রাখতে পারে না।
তারপর যেটা হয় তুমি অনুঘটক ওই মেয়েটির সাথে পরিচয়বদ্ধ হয়ে পড়ো। ওই আনন্দের উৎস যে তুমি নিজে তা ভুলে গিয়ে ওই অনুঘটকেই প্রধান মনে করো। একবার পরিচয়বদ্ধ হওয়ার ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে তোমার বুদ্ধি নানা কূট কৌশল নিয়ে হাজির হয়। কীভাবে তাকে আবার দেখা যাবে, কীভাবে ফোন নম্বর পাওয়া যাবে, কীভাবে কাছাকাছি হওয়া যাবে, কতটা ছুটতে হবে সবকিছুর পথ সে দেখাতে থাকে। ওই পথে পা বাড়ানোর সাথে সাথে তুমি দুঃসাহসী হয়ে ওঠো। মানে আনন্দ চিরকালের মত মাটি। এটা অবশ্যম্ভাবী। কারণ তুমি নিজকে ফেলে অন্যকে অগ্রাধিকার দিচ্ছ। অর্থাৎ বাঁশের চেয়ে কঞ্চি মোটা হয়ে গেলে বিপত্তি অনিবার্য। অনুঘটক ঘটনা ঘটিয়ে বিদ্যুৎ চমকের মত কোন আকাশে হারিয়ে গেছে এখন তুমি তার জন্য দেওয়ানা। জীবন বাজি রাখার মত দুঃসাহস তোমার! জান কুরবান সই! অন্তর্মুখী না হয়ে বহির্মুখী এই বিপত্তিটাকে প্রেম নামে চালানো হয়। এটাকে নিয়ে পৃথিবীজুড়ে হাজারো বোকা বোকা সাহিত্য রচিত হয়েছে এবং হচ্ছে। সাহিত্য তথা গানে, কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে সিনেমায় এই পাগলামীটাকে চূড়ান্ত বলে দেখানো হয়। এই বাজে রেকর্ড যুগের পর যুগ ধরে এত ব্যাপকভাবে বাজানো হয়েছে যে মানুষের মানসপটে এটা ভিন্ন আর কোনো ভাবনা বা দৃশ্য নেই। গুরুজন, অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী অর্থাৎ প্রায় সবাই এই পাগলামীতে আচ্ছন্ন। সবাই যার যার মত তার তার সোনার হরিণ খুঁজে বেড়াচ্ছে। কেউ সর্বশক্তি দিয়ে হন্যে হয়ে, কেউ গোপনে, কেউ কৌশলে যার কোনো উপায় নেই সে মনে মনে পস্তাচ্ছে। সবাই জ্বলে পুড়ে অঙ্গার কিন্তু কেউ এর চিকিৎসা জানে না। সবাই সুখের অভিনয় করে বাঁচে। আর এ প্রাপ্তিহীন বাজে অভিনয় করতে করতে পৃথিবীর মানুষ আজ সত্যি ক্লান্ত। তুমি যদি লক্ষ্য করো দেখবে একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত মানুষ এই পাগলামীর চূড়ান্ত পক্ষে থাকে। আর নির্দিষ্ট বয়সের পরে চূড়ান্তভাবে এর বিপক্ষে চলে যায়। তারা তখন জুনিয়রদের অনেক উপদেশ দেয় কিন্তু কেউ- ই তাদের কথা শোনে না।
অনুঘটক ঘটনা ঘটিয়ে বিদ্যুৎ চমকের মত কোন আকাশে হারিয়ে গেছে এখন তুমি তার জন্য দেওয়ানা। জীবন বাজি রাখার মত দুঃসাহস তোমার! জান কুরবান সই! অন্তর্মুখী না হয়ে বহির্মুখী এই বিপত্তিটাকে প্রেম নামে চালানো হয়।
আচ্ছা এবার ধরো যেভাবেই হোক ওই মেয়েটার সাথে তোমরা যাকে প্রেম বলো সেটি হলো। তারপর দু’জন দু’জনার প্রতি খুব সিরিয়াস হয়ে পড়লে।বেড়ে গেল দায়িত্ব, বেড়ে গেল টেনশন। দিন একশত বার একজন বলবে বাবু খেয়েছো? অন্যজন বলবে খেয়েছি সোনা। দু’জন দু’জনের কাছে নিজের স্বাভাবিকতাকে লুকিয়ে সর্বোচ্চ ভালো সাজার নাটক চলতে থাকে।
খুব অল্পদিনের মধ্যে এই নাটক ক্লাইমেক্স অতিক্রম করে। কারোরই চাওয়া পাওয়ার সমীকরণ মেলে না। দ’জনেরই সকল ছদ্মবেশ আলগা হয়ে যায়। ফলে শুরু হয় মনোমালিন্য, রাগারাগি, ঝগড়াঝাঁটি, কথা ও মুখদেখাদেখি বন্ধ, আহার নিদ্রাহীন রক্তাক্ত শরীর, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ, আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠা ইত্যাদি।
যাইহোক, এর শেষ পরিনতি কী? হয় ব্রেকআপ না হয় বিবাহ। যার কোনোটাই সুখের নয়। ব্রেকআপে আত্মহত্যার কথা প্রায়ই সোনা যায়। মাদকাসক্ত হয়ে পড়াটা তো খুবই কমন। নিদেনপক্ষে ক্যারিয়ারটা হুমকিতে ফেলে বেশিরভাগ মানুষ। আর যদি তুমি বিয়ে করো তবে তো কথায় নেই। পদে পদে দ্বন্দ্ব- সংঘাত, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। সামান্য একটা কথা বা একটুখানি আবদার বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। অনেকে সংসারকে অন্তহীন যুদ্ধক্ষেত্র বলে অভিহিত করেছেন। আজ দম্পতিদের মধ্যে হয়ত শতকরা একজনকেও পাওয়া যাবে না যারা একবারের জন্য হলেও বিচ্ছেদের কথা ভাবে নি।

তাহলে এখন বোঝো, এই যে বিপত্তি, বিপর্যয় একে কি প্রেম বলা যায়? না না। এটা প্রেম নয়, প্রেমরোগ। তুমি এই গ্রহে প্রেমের যত অমর গল্প শুনেছো তারা কেউ- ই প্রেম নামক অমৃতের সন্ধান পায় নি। সে তুমি দেবদাস, চন্ডীদাস -রজোকিনী, রোমিও- জুলিয়েট যাদেরই নাম বলো না কেন! তাদের পাগলামীটা চূড়ান্ত পর্যায়ের ছিল এই যা। মানে মরণব্যাধি আর কি!
এখন প্রশ্ন হলো এর বাইরে কি কেউ নেই? কেউ ই কি সুখে সংসার করছে না?
উত্তর হলো, হ্যাঁ করছে। দু’জনের মধ্যে কেউ একজন চুপ হয়ে গেছে বলে। সে যে কারণেই হোক। হতে পারে শারীরিক চাহিদা আছে অথবা মানসিক, আবেগগত, সামাজিক, ধর্মীয় বা আর্থিক যে কোনো কারণে চুপ হয়ে গেছে। অনেকের ক্ষেত্রে এটা ঘটে শুধু সন্তানের মুখ চেয়ে। সম্পূর্ণ জেনে বুঝে আধ্যাত্মিক কারণে চুপ হয়ে গেছে এমন মানুষ খুব কমই আছে। এমনটা হলে তো চমৎকার! আর দু’জনেই যদি হতে পারে তবে তো সোনায় সোহাগা!
যেভাবেই হোক, এই চুপ হতে পারাটা কিন্তু আধ্যাত্মিক। এটা অন্তর্মুখী হওয়ার লক্ষণ। তুমি যদি ওই অনুঘটকের উদয়কালে প্রথম পুলকানন্দের সময় চুপ হয়ে যেতে, যদি অনুসন্ধান করতে সুখের উৎসটা, তাহলে এত এত যন্ত্রণা তোমাকে ভোগ করতে হত না। দিশাহীন ছুটে চলা কোনো সমাধান নয়। এই যে চুপ হতে পারা, স্থীর হতে পারা এটাই সব।