Read In English
WHO AM I? কে আমি? মিলিয়ন ডলার কোশ্চেন?

প্রশ্ন: স্যার আপনি বলেছিলেন জীবনের সকল ভোগান্তি শেষ করতে হলে সবার আগে আত্মজ্ঞান লাভ করতে হবে। আত্ম মানে নিজ বা আমি। আত্মজ্ঞান মানে” আমি ” বিষয়ক জ্ঞান। তার মানে এই আমিটা হল আসল। স্যার আমি আপনার কাছে জানতে চাই এই আমিটা আসলে কে? Who am I?
উত্তর: Who am I? কে আমি? প্রশ্নের সাইজটা বেশ ছোট। কিন্তু এর ব্যাপ্তি ও গভীরতা খুবই বড়। আমরা বন্ধুরা একে মজা করে বলতাম মিলিয়ন ডলার কোশ্চেন। আদতে এর মূল্য তারও বহুগুণ বেশি। কারণ এই একটা প্রশ্নের সমাধান হয়ে গেলে মানবজীবনের প্রায় সব সমস্যারই সমাধান হয়ে যায়।
তো চলো দেখি কে তুমি? ক্ষণিকের জন্য চোখ দুটো বন্ধ করো। কী অনুভব করছ? তোমার শরীরকে। যা তোমার সবচেয়ে কাছের জিনিস। ওকে জিজ্ঞাসা করো কে তুমি? ও উত্তর দেবে তোমার শরীর। হ্যাঁ ওটা তোমার শরীর। তুমি নও। কারণ তুমি ওটা জড়ো করেছো। মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় নাভীর সাহায্যে মায়ের পুষ্টি থেকে তোমাকে পুষ্ট করা হয়েছে। আর পৃথিবীতে এসে মায়ের দুধ থেকে শুরু করে সব ধরণের খাবারই তুমি খাচ্ছো।

খাবার খেয়ে খেয়ে তুমি এই শরীর বানিয়েছো। তোমার শরীর মূলত খাবারের স্তুপ। যা কিছু তুমি জড়ো বা সঞ্চয় করো তা তোমার হতে পারে কিন্তু” তুমি ” হতে পারো না। যেমন,তোমার হাতের মোবাইলটা এটা তোমার কিন্তু তুমি নও। একই ভাবে তোমার ড্রেস, কলম ইত্যাদি কোনটাই তুমি নও। একই ভাবে তোমার হাত, পা, চোখ, কান, নাক,মুখ,বুক,পেট,এমনকি তোমার পুরো শরীর– তোমার।” তুমি” নও। কোনো দুর্ঘটনায় শরীরের বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্ন হওয়া মানুষকে দেখেছো? দেখবে হাত-পা বা দুটোই নেই তবু সে আছে। তাহলে বোঝা গেলো এই শরীরটা তোমার। কিন্তু ” তুমি” নও।
এবার চলো তোমার মনকে পরীক্ষা করা যাক। আবারো চোখ বন্ধ করে ওকে প্রশ্ন করো কে তুমি? ও উত্তর দেবে ” তোমার মন”। কখনো মন খারাপ হলে কী বলো? বলো ” আমার মন খারাপ”। কখনো বলো না ” আমি খারাপ”। আদতে তোমার মনও জড়ো করা বস্তু। তোমার বাবা- মা, পরিবার, আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু- বান্ধব, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, সম্প্রদায়, রাষ্ট্র, ধর্ম,মতবাদ, শিল্প, সাহিত্য ইত্যাদির কাছ থেকে তুমি অনবরত শিখেছো, অনুকরণ করেছো এবং বহু কিছু আত্মস্থ করেছো। নানা ধরণের পরিচয়ে তুমি নিজেকে বেঁধেছো আর সেই পরিচয়গুলোকে রক্ষা করতে তোমার বুদ্ধি নানা ধরনের ফন্দি বের করছে। এই সবকিছু মিলিয়ে তোমার ভিতরে একধরণের বোধ,বুদ্ধি, আইডিয়া, পছন্দ- অপছন্দ, ভালোলাগা – মন্দলাগা ইত্যাদি তৈরি হয়েছে–যাকে তুমি “মন” নামে ডাকছো।

তোমার মন আসলে তোমারই জড়ো করা নানা data বা তথ্যের স্তুপ। ঘটে যাওয়া ঘটনার স্মৃতি। মন এই জমানো তথ্যকে সারাক্ষণ পরিমার্জন, পরিবর্ধন বা cut,copy, paste করে নানা চিন্তা -ভাবনা, ধারণা, আশঙ্কা, ভয়,কল্পনা ইত্যাদি আকারে প্রকাশ করতে থাকে। যার যার মনে চলা নাটক তার তার কাছে এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে সে পৃথিবীর অন্যকিছু প্রায় খেয়ালই করে না। মানুষের মনে চলা সিনেমার প্রতি মগ্নতা এতবেশি যে সে অন্য কাউকে গুরুত্বই দেয় না। এই মনের জালে ফেঁসে নাকানিচোবানি খেয়ে, কেঁদে কেটে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। মন যদিও দুর্দান্ত এক যন্ত্র এবং এর উচ্চতর মাত্রা রয়েছে। মনের উচ্চতর মাত্রাকে স্পর্শ করতে পারলে মানুষ পেতে পারে এক ধন্য জীবন কিন্তু মনের যে মাত্রাটা সর্বদা সক্রিয় থাকে তা কেবল অতীতের ধূলো। ঘটে যাওয়া ঘটনার স্মৃতি ঘেটে আর যাই হোক তুমি নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারবে না। তোমার যদি এখানে জন্ম না হয়ে অন্যদেশে জন্ম হতো তবে তোমার মনও অন্য রকম হতো। ধর্ম ভেদে মানুষের মন আলাদা। তাহলে বোঝা গেল মন কোনো শ্বাশত সত্তা নয়। মন তোমারই জড়ো করা বস্তু।” তুমি” নও।
এবার চলো “আবেগ” নিয়ে কথা বলা যাক। আবেগ হলো রসালো চিন্তা। চিন্তারই একটা তীব্র মাত্রা। এটা মূলত জীবনের রস। এটা আছে জীবনকে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত বা প্রস্ফুটিত করতে। জীবনকে তার সমগ্রতায় বুঝতে আবেগ এক শক্তিশালী যন্ত্র। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ আবেগকে এই মাত্রায় স্পর্শ করতে পারে না। মানুষ আবেগকে কাজে লাগাতে চায় জীবনের ছোটখাটো বিভিন্ন জিনিস পাওয়ার জন্য। যৌনতা চরিতার্থ করতে মানুষ আবেগকে ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি। প্রথমের দিকে এটা কাজ করে তাই মানুষ আবেগের প্রয়োগ বাড়াতে থাকে এবং জীবন কদর্য হয়ে ওঠে।

আবেগের বাড়াবাড়ি মানেই জীবন ভারসাম্যহীন ও অনিয়ন্ত্রিত যা আদতে দুর্ভোগ। তুমি প্রেমে, ধর্মে, সম্প্রদায়ে, জাতীয়তায়, সম্মানের প্রশ্নে তথা সর্বত্র যে সংঘাত দেখো তার মূলে রয়েছে আবেগের বাড়াবাড়ি। মানুষ Emotional Intelligent হলে ফুলের মত ফুটে উঠতে পারে কিন্তু তা না হয়ে Emotional blackmailing এ দক্ষ হয়ে ওঠে। তুমি সমাজপতি থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, ধর্মব্যাবসায়ীসহ বহুক্ষেত্রে আবেগের সুড়সুড়ি ব্যবহার করে ফায়দা লোটার নানা কৌশল হয়ত লক্ষ্য করেছো। তো — এই আবেগটা তোমার মধ্যে জড়ো হয় প্রথমত বাবা- মায়ের দেখানো উচ্চাভিলাষি স্বপ্নের মধ্য দিয়ে। তারপর তুমি প্রভাবিত হও কার্টুন, সিনেমা,নাটক,বন্ধু, শিক্ষক ইত্যাদি দ্বারা যার কোনোটাই তুমি নও।
এবার চলো দেখি প্রাণশক্তি কী জিনিস? বেশিরভাগ মানুষ তার শরীরের চাহিদা, মনের নাটক,আর আবেগের যন্ত্রণা অতিক্রম করে প্রাণের প্রতি দৃষ্টি দিতে পারে না। অথচ প্রাণ জীবনের সবচেয়ে মৌলিক, অত্যন্ত কার্যকর, সর্বদা সক্রিয় এবং বুদ্ধিমান শক্তি — যা সম্পূর্ণ শরীরতন্ত্রের কার্যকারিতা নির্ধারণ করে। প্রাণ কীভাবে তোমার মধ্যে কাজ করে,বাকি মহাবিশ্বের সাথে লেনদেন করে, নবজাতকের মধ্যে প্রবেশ করে ও মৃতকে ছেড়ে চলে যায়—- এগুলো স্পষ্টভাবে দেখায় যে তার নিজস্ব বুদ্ধি রয়েছে। মানুষের কর্মের স্মৃতির ছাপ প্রাণের উপর রয়েছে বলে এটা প্রত্যেকের জন্য আলাদা ভাবে কাজ করে। এটা বিদ্যুৎ শক্তির মতো নয় কারণ বিদ্যুৎ এর নিজস্ব কোনো বুদ্ধি নেই। কিন্তু প্রাণের নিজস্ব বুদ্ধি রয়েছে। এটা রয়েছে বলেই অনেকে প্রাণশক্তিকে রূহ বলে ভুল করে। আসলে তার সুযোগ নেই কারণ প্রাণ বুদ্ধিমান শক্তি হলেও তারও একজন উৎপাদনকারী, সংরক্ষণকারী ও পরিবেশনকারী রয়েছে এই শরীর তন্ত্রের মধ্যেই। ওটাই হল জীবনের মৌলিক প্রকৃতি, রূহ বা” তুমি”– যা প্রাণের সীমানার বাইরে। ওটাই হল একমাত্র আসল জিনিস বাকিগুলো কেবল চিন্তাভাবনার প্রক্ষেপণ বা অনুমান মাত্র। তুমি যদি জীবনের এই মূলগত সত্তার প্রতি মনোনিবেশ করো এবং এটা যদি তোমার জীবনের একমাত্র অগ্রাধিকার হয় অর্থাৎ ধ্যানমগ্ন হয়ে ওঠো তবে তুমি অবশ্যই পৌছে যাবে এমন এক সত্তায় যা সৃষ্টির উৎস,সমস্ত কিছুর ভিত্তি অর্থাৎ স্বয়ং স্রষ্টায়।